কৃষকরাই হচ্ছে দেশের মূল চালিকা শক্তি। তাদের নিরলস শ্রমের কারণে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়। তবে দামি রেস্তোরাঁয় বসে সুস্বাদু খাবার উপভোগ করার সময় আমরা ঠিক কতটা তাদের সমস্যা নিয়ে ভাবি? আজও তারা প্রতিনিয়ত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দ্বারা শোষিত হচ্ছে। আমি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। আমার উদ্যোগের চেষ্টা ছিল কৃষকদের শোষণ এবং দুর্দশাকে মোকাবেলা করার একটি কার্যকরী সমাধান খুঁজে বের করা।
২০১৪ সালে আমি সাকো এন্টারপ্রাইজটি চালু করি। পূর্বে আমি সাকো এনজিওর সাথে যুক্ত ছিলাম যেটি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। সেখানে কাজ করার সময় আমি খেয়াল করি, বরগুনায় প্রচুর পরিমাণে মুগ ডাল উৎপাদন হয়। তারপর এই ডাল কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মুন্সিগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত ডাল বরগুনায় এনে আরও বেশি দামে বিক্রি করা হয়। আমি বুঝতে পারলাম বরগুনায় মুগ ডাল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা না থাকার কারণে, পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। ফলস্বরূপ, মুগ ডালের দাম বেড়ে যায়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বরগুনায় একটি কারখানা চালু করব।
আমার এক আত্মীয়ের সাহায্য নিয়ে বরগুনায় এক টুকরো জমি কিনলাম। এরপর লক্ষ করলাম, ভোক্তাদের কাছে অতিরিক্ত দামে নিম্নমানের ডাল বিক্রি করে তাদেরকে প্রতারিত করা হচ্ছে। তাই আমি উন্নত মানের ডাল সরবরাহের জন্য স্থানীয় কৃষকদের সাথে একটি চুক্তি করি। বর্তমানে আমার উদ্যোগটি বরগুনা জেলার ২০০০ কৃষকের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
আমার কাজের নিয়ম হল- প্রতিটি অঞ্চল থেকে আমি একজন কৃষক নিযুক্ত করি, যার দায়িত্ব থাকে সেই অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে ফসল সংগ্রহ করা এবং কমিশনের বিনিময়ে এ ফসল প্রক্রিয়াকরণের জন্য সাকো-তে পাঠানো। এতে করে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ই প্রতারণার হাত থেকে বাঁচে ও আনুসঙ্গিক কাজের চাপ থেকে মুক্তি পায়।
২০১৮ সালে আমার নজরে আসে যে বেশ কিছু জাপানি ব্যবসায়ী বরগুনার কৃষকদের কাছ থেকে ডাল কিনছেন। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, জাপানিরা এই ডাল দিয়ে প্রোটিন সমৃদ্ধ স্প্রাউট তৈরি করে এবং সেগুলি জাপানের স্কুলে বিতরণ করে। এ থেকে আমার মাথায় আসে আমার দেশের অপুষ্টিজনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য স্প্রাউট কে জনপ্রিয় করা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা ছিল, স্প্রাউট কি এবং এটি কিভাবে বানানো হয় এ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না।
আমি এ নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। ইতোমধ্যে একজন ভারতীয় স্প্রাউট উৎপাদনকারির সাথে আমার যোগাযোগ হয়। তিনি আমাকে স্প্রাউট তৈরির পদ্ধতি শিখতে সাহায্য করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের স্প্রাউটের ইতিহাস। দেশের সর্বত্র স্প্রাউট এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য আমি পিকেএসএফের সাহায্য চাইলাম। পরবর্তীতে তারা আমাকে বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়ার্কশপ আয়োজন করতে সহায়তা করে। পিকেএসএফ এর মাধ্যমে আমি লাইটক্যাসল পার্টনার্স এক্সেলেরেটর প্রোগ্রামের কথা জানতে পারি। গত বছর আমি আমার উদ্ভাবন এর জন্য একটি ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম থেকে বিনিয়োগ মূল্য হিসেবে ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার জিতি। সান বিজনেস নেটওয়ার্ক এবং গেইন আয়োজিত ২০১৮ সালের জাতীয় প্রতিযোগিতা, বাংলাদেশ নিউট্রিস্টারের রানার্সআপ হয়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার প্রাইজমানিও জিতে সাকো। এই বিনিয়োগ মূল্য আমার ব্যবসার লক্ষ্যকে আরও প্রসারিত করেছে।
আমার ব্যবসার যাত্রা এতোটাও সহজ ছিল না। এ পর্যায়ে আসতে আমাকে নানা চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে। শ্রম সংকট এবং বরগুনার প্রতিকূল আবহাওয়া আমার ব্যবসার অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। করোনায়ও ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়। ঠিক ডাল চাষের মৌসুমেই মহামারিতে আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা চলমান রাখতে লকডাউন চলাকালীন আমি স্প্রাউট বিক্রি করেছি। দক্ষিণাঞ্চলে আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় ডাল শুকাতে বেশি সময় লাগে, যার কারণে উৎপাদন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পায়। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে আমি এই সমস্যাটি সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারব।
বর্তমানে আমি আমার কারখানাটি জেলা শিল্প নগরী প্লটে স্থানান্তর করে সেখানে একটি অটো মিল চালু করার পরিকল্পনা করছি। এই কারখানায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে। এটি প্রতিষ্ঠা করতে আমার ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। তাই এখন আমার উদ্দেশ্য এ পরিমাণ অর্থ যোগাড় করে আমার কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা।