Delowar Hossain and Shelly Apa
মোমিতা ফ্লাওয়ার্স
795 Views

প্রায় সতের বছর আগে, আমি এবং আমার স্বামী দেলোয়ার, মোমিতা ফ্লাওয়ার্সের সাথে আমাদের যাত্রা শুরু করি। কৃষক পরিবারে দেলোয়ারের জন্ম। সেখান থেকেই তিনি তার খামার শুরু করার অনুপ্রেরণা পান। দেলোয়ার তার বাবার কাছ থেকে কৃষিকাজ শিখেছেন। তার স্বপ্ন ছিল নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আরও বড় কিছু করার।  

গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় দেলোয়ার লক্ষ করতেন বাজারে সুন্দর ফুলের বেশ চাহিদা। তিনি এই সুযোগটি কাজে লাগাতে নেমে পড়লেন। আমিও তার সাথে ব্যবসায় যোগ দেই। এভাবেই শুরু হয় আমাদের দু:সাহসিক যাত্রা। 

প্রথমে আমরা গ্লাডিওলাস ফুলের বাল্ব দিয়ে বাণিজ্যিক ফুলের চাষ শুরু করি। সতের বছর আগে আমাদের পরিবারের কেউই আমাদের ফুলের ব্যবসাকে লাভজনক মনে করে নি। তারা ভাবতেন আমরা পাগল হয়ে গেছি। পরিবারের সদস্যরাও আমাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করতেন কারণ তারা বিশ্বাস করতেন না যে ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা ঠিক করি, যে যা-ই বলুক আমরা  আশা হারাব না। একবারের জন্যও থেমে যাওয়ার কথা ভাবিনি আমি, ভাবেন নি দেলোয়ারও।

সেই সময়ে, ফুলকে শস্য হিসেবে গণ্য করত না বাংলাদেশ সরকার। এ কারণে ফুল চাষিরা সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সহায়তা পেতেন না। কিন্তু আমরা আমাদের ব্যবসা চালিয়ে যাই এবং কয়েক বছরের মধ্যেই বেশ উন্নতি দেখতে পাই।

আমরা বিশ্বাস করি, এই সতের বছরে আমরা বাংলাদেশের ফুল ব্যবসায় বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেরেছি। ব্যবসার শুরুর দিকে আমরা লক্ষ করি, বাংলাদেশের এই খাতটি আমদানি-নির্ভর। আমরা এটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিই । আমরা নেদারল্যান্ডস থেকে বিদেশী গোলাপের বীজ সংগ্রহ করে আমাদের খামারে চাষ শুরু করি।  ইতোমধ্যে মোমিতা ফ্লাওয়ার্স তিন লক্ষ টাকার বিদেশি গোলাপ বিক্রি করেছে। আজ অবধি, আমরা বাংলাদেশের একমাত্র বিদেশী গোলাপ উৎপাদনকারি। এছাড়াও আমরা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে হাই-টেক নার্সারি গড়ে তুলি। বাংলাদেশে স্ট্রবেরি উৎপাদন করা সম্ভব না, এমনকি করা গেলেও সেগুলি আন্তর্জাতিক মানের হয় না, এই ভ্রান্ত ধারণাও সফলভাবে ভুল প্রমাণ করি আমরা।

মোমিতা ফ্লাওয়ার্স যত বড় হল, আমাদের ব্যবসাকে আরও ভালভাবে বুঝতে এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা পেতে আমরা বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শ চাইলাম। এরই ধারাবাহিকতায়, লাইটক্যাসল পার্টনার্স এক্সেলেরেটর প্রোগ্রামেরও একটি অংশ ছিলাম আমরা। এখানে তারা আমাদেরকে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ মডেল, বিপণনের কৌশল, পিচ ডেক প্রস্তুতকরণ এবং বিনিয়োগকারী ও ব্যাঙ্কের কাছে আর্থিক বিনিয়োগের বিষয়ে শিখিয়েছিলেন।

প্রতিটি সফল গল্পের মতোই, মোমিতা ফ্লাওয়ার্সকেও কিছু কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি, কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের সকলকে লকডাউন এ যেতে বাধ্য করে। ফলে অসংখ্য উদ্যোক্তার জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। মোমিতা ফ্লাওয়ার্সও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মহামারি কালে আমাদের চোখের সামনে ১৪ লক্ষ টাকার ফুল নষ্ট হয়! সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যবসার ৪০-৫০ লক্ষ টাকা লোকসান হয়।

এই টাকার পরিমাণ যে কোনও ছোট ব্যবসায়ীর আত্মবিশ্বাস এবং ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই ভয়ংকর সময়েও আমরা আশা হারাই নি। লকডাউনের পুরোটা সময়ে আমাদের বিক্রি বন্ধ ছিল। তবে আমরা এই দুঃসময়কে কাজে লাগানোর উপায় বের করি। আমরা আমাদের দুটি উচ্চমূল্যের ফসল- স্ট্রবেরি এবং ক্যাপসিকাম, দুর্গত রোগিদের সহায়তার জন্য দান করি। লকডাউনে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান যখন অর্থব্যয় কমানোর জন্য তাদের কর্মচারিদের ছাটাই করার কথা ভাবছিল, তখন মোমিতা ফ্লাওয়ার্স সাহসিকতার সাথে তাদের কর্মচারিদের পাশে দাঁড়ায়। একজনকেও ছাটাই করি নি আমরা। একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিশ্বাস নিয়ে আমরা আমাদের গাছের লালন-পালন চালিয়ে যাই। 

আমরা বেশ কিছু বছর ধরে সফলভাবে আমাদের ফুল রপ্তানি করছি। ভবিষ্যতে স্ট্রবেরি, বিদেশী গোলাপ এবং ক্যাপসিকাম রপ্তানিরও প্রত্যাশা করছি। আমরা স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশকে ফুল চাষে স্বাবলম্বী করার যাতে আমাদের দেশকে আমদানি-নির্ভর হতে না হয়। আমরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের এবং অন্যান্য ফুল চাষিদের চাষ প্রক্রিয়াটিকে সহজ করতে চাই। আশা করি আমরা মোমিতা ফ্লাওয়ার্স এর মধ্য দিয়ে এ স্বপ্নগুলি বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারব।