আমার পুত্রের বয়স যখন ১১ মাস, তখন আমার স্বামী ব্রেন ক্যান্সারে মারা যান। তার চিকিৎসা করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বেশ কিছুদিন ক্যান্সারে ভুগে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে যান আমাকে আর আমার শিশু সন্তানকে এই কঠিন পৃথিবীতে একা ফেলে। তার মৃত্যুর পরেই, আমার সন্তানসহ আমাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়। আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে চলে আসি। তবে হিন্দু রীতি অনুসারে, মেয়েদের বিয়ের পরে বাবা-মায়ের সাথে থাকার নিয়ম ছিল না।
আমি বলছি ২০ বছর আগেকার কথা। সেই সময়ে, আমাদের সমাজ আজকের মতো এতটা প্রগতিশীল ছিল না। খুব দ্রুত আমাকে উপার্জনের একটি উপায় খুঁজে বের করতে হয়। আমার সন্তানের জন্য, নিজের জন্য। আমি অন্যান্য কৃষকদের জমিতে কাজ শুরু করলাম। তখন এটাই ছিল আমার জন্য একমাত্র কাজের উপায়। যদিও এই কাজ আয়ের স্থায়ী উৎস ছিল না, কারণ কেবল চাষের মৌসুমেই কাজ পাওয়া যেত। তবে আমার এবং আমার ছেলের কোনমতে খেয়েপড়ে দিন চলে যেত। আমি তখন খুব অল্পবয়সী ছিলাম। আমি ঠিক মনে করতে পারি না, বয়স কুড়ির মত।
আমাদের মত নিম্ন আর্থ-সামাজিক পটভূমি থেকে আসা মানুষের জন্য জীবন সহজ নয়। তার উপর, আমি ছিলাম প্রত্যন্ত ডুমুরিয়া অঞ্চলের একটি গ্রামে একজন হিন্দু বিধবা মা। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার পায়ের নিচে শক্ত মাটি দরকার। কারো উপর আমি নির্ভর করতে পারি, এমন কেউ আমার ছিলনা। আমি অন্যের জমিতে কাজ চালিয়ে গেলাম আর সঞ্চয় করতে থাকলাম। প্রায় সাত বছর মাঠে কাজ করার পরে, আমার মনে হল এখন আমার নিজের ব্যবসা শুরু করা উচিত।
আমার যে সামান্য সঞ্চয় ছিল, তা দিয়ে আমি তিনটি বাছুর কিনি। তারা বড় হলে, আমি তাদের দুধ বিক্রি করা শুরু করলাম । তবে আমি বাজারে গিয়ে নিজে বিক্রি করতে সাহস পেতাম না। তাই, আমি গ্রামের অন্য একজনের কাছে যাই, যিনি একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবেন এবং কিছু কমিশনের বিনিময়ে আমার গাভীর দুধ বিক্রি করবেন। বেশ কিছুদিন ধরে এইভাবে আমি ব্যবসা করছিলাম। একদিন আমি বুঝতে পারি, তিনি আমাকে প্রতারিত করছেন।
স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, তিনি বাজারে অনেক বেশি দামে দুধ বিক্রি করছেন কিন্তু আমাকে তার খুব সামান্য অংশ দিচ্ছেন। এ কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। একটা মানুষ কিভাবে কারও দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে? বিশেষ করে একজন বিধবা মায়ের এত বছরের লড়াই সম্পর্কে জানার পরেও? অনেক চিন্তাভাবনার পরে আমি স্থির করলাম যে যাই হোক না কেন, আমি আমার পণ্যগুলি বিক্রি বন্ধ করবনা। এখন আমি নিজে ভ্যান চালিয়ে দুধ বাজারে নিয়ে বিক্রি করি। শুরুতে আমি প্রতিদিন ৩ কেজি দুধ বিক্রি করতাম। এখন, আমি দৈনিক ৩০ কেজি দুধ বিক্রি করছি।
আমি এবং আমার ছেলে অনেকটা পথ এসেছি। এ পথ আমাদের জন্য পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না। আমাদের অনেক বাধা-বিপত্তি ও সামাজিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সময় এখন অনেকটা বদলালেও, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিধবা নারীর জীবন এখনও সহজ নয়। তবে আমি এখন আত্মবিশ্বাসী। আমি জানি এ বাধাগুলি আমি অতিক্রম করতে পারব। আমার নিজের ব্যবসাটির বয়স ১৬ বছর হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলেকে বড় করেছি এবং তাকে যথাযথ শিক্ষাও দিতে পেরেছি। বর্তমানে আমি একটি মিষ্টির দোকান দিয়েছি। দোকানটি বেশ ভালভাবেই চলছে।
জীবন আমাকে সবসময়ই একটার পর একটা কঠোর বাস্তবতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, তাই মহামারি আমার মধ্যে কোনও ভয় সৃষ্টি করতে পারেনি। কোভিড -১৯ এ দেশব্যাপী লকডাউন দেওয়ায়, বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাকে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হয়েছিল। দিনের বেলায় জনসমাগমে ব্যবসা করার নিয়ম ছিল না। তাই ভোর হতেই কাছের মন্দিরে দুধ বিক্রি শুরু করি। প্রায় সবাই তখন ঘুমিয়ে থাকত। কেবল যারা দুধ কিনতে আগ্রহী, তারাই মন্দিরে আসত।
আমি জানি আমার লড়াই এখানে শেষ নয়। আমাকে আরো অনেক দূর এগোতে হবে। আমি জীবন থেকে অনেক কিছু শিখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের আসল অর্থও বুঝতে পেরেছি। এখন আমি আগের চেয়ে সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীনচেতা। আমার হতাশার দিনগুলি শেষ। এখন আমি শুধু নিজের এবং আমার ছেলের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। ভবিষ্যতে আমার মিষ্টির দোকানকে আরো বড় করার পরিকল্পনা করছি। এজন্য আমার প্রায় ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই পরিমাণ বিনিয়োগ অর্থ পেলে আমি আমার ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।