আমাদের দেশে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নারীরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত হয়ে আসছে। আমি এই নারীদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু করি “ব্রিন্তা জুটস”। এ সংস্থায় নারীরা তাদের সৃজনশীলতা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পাটের বিবিধ পণ্য উৎপাদন করার সুযোগ পায়। ২০০৬ সালে এক ভয়াবহ সময় আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে আমাকে একাই নামতে হয়। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ আমাকে তাড়িয়ে দেন। একটি কন্যা সন্তান নিয়ে আমি ছিলাম একজন তরুণী বিধবা। আমি তাদের সাথে থাকলে সমাজে তাদের মান-সম্মান থাকবেনা, সমাজের কাছে তারা হয়ে উঠবেন উপহাসের পাত্র- এমন অজুহাত দিয়ে তারা আমাকে বাসা ছাড়তে বাধ্য করেন। আমি আমার বাবা-মার বাসায় আশ্রয় নেই। কিন্তু আমি তাদের বোঝা হতে চাইনি। খুব দ্রুত আমাকে একটি উপায় বের করতে হত।
সে সময় আমি একটি বেসরকারি চাকরি করতাম। কিন্তু চাকরির অতি সামান্য বেতন দিয়ে চলা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই আমি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মেয়ে তখনো একদম ছোট। খালি হাতে একটা ব্যবসা দাঁড় করানো কোনো সহজ কাজ নয়। আমাকে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হত। আমার বাচ্চার সঠিক দেখভালের জন্য আমি একটি বোর্ডিং স্কুলের খোঁজ করছিলাম। তবে আমি আমার সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ আমার অভিজ্ঞতায় ইংরেজি ভাষায় ভাল দক্ষতা না থাকার কারণে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক ভাল ভাল চাকরি ইংরেজির দক্ষতার অভাবে হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই আমি চাইতাম না আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটুক।
অনেক খোঁজার পর দার্জিলিং এ আমি আমার সাধ্যের মধ্যে একটি বোর্ডিং স্কুলের সন্ধান পাই। আমি আমার মেয়েকে সেখানে পড়াশুনার জন্য ভর্তি করে ঢাকায় ব্যবসায় মনোযোগ দেই। শুরতে ব্যবসার অর্থ যোগাতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অনেকদিন যাবত ব্যবসা থেকে নিয়মিত আয় হচ্ছিলনা। এই দিনগুলি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টে কাটানো সময়। কিভাবে আমি দৈনিক খরচ চালাব এই চিন্তায় রাতে ঘুম হতনা। এত অনিশ্চয়তার মাঝেও আমি টিকে থাকতে পেরেছি, এই ভেবে আমার নিজের উপর গর্ব হয়।
বৃন্তা জুটস পাটের বিবিধ পণ্য তৈরিতে পারদর্শী। আমাদের সেরা পণ্যগুলি হল পাটের ব্যাগ এবং ক্রিসমাস সজ্জা। দেশ ও দেশের বাইরে আমাদের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক। ঢাকার বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের কাছে আমাদের পণ্যগুলি বেশ প্রশংসিত। বাংলাদেশের অন্যতম ফ্যাশন চেইন ‘ঐক্য’ স্টোরের পরিবেশক হিসাবে আমরা তালিকাভুক্ত। আমাদের পণ্য জেডিপিসি (জুট ডাইভার্সিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার) এর কাছেও বিক্রি হয়। এছাড়া জাপানেও আমাদের পাটের ব্যাগ এবং ক্রিসমাস সজ্জার প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
আমি টিএফও কানাডার একটি প্রকল্পের অংশ ছিলাম যার মাধ্যমে আমার লাইটক্যাসল পার্টনার্স এর সাথে যোগাযোগ হয়। লাইটক্যাসল পার্টনার্সের মাধ্যমে আমি পণ্য বিপণন, বুককিপিং এবং ব্যবসায়ের সামগ্রিক পরিচালনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি। এ জ্ঞান আমার নিজের ব্যবসার লাভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে।
“মণিপুরী নারী ও শিশু উনয়ন ফাউন্ডেশন” নামে আমার নিজস্ব একটি এনজিও আছে, যা ব্রিন্তা জুটস এর একটি সহপ্রতিষ্ঠান। এই এনজিওর মাধ্যমে আমরা ব্রিন্তা জুটস এর শ্রমিকদের বাচ্চাদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকি। আমরা তাদের শিশুদের নৈতিক শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেই, যাতে তারা ভাল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। আমাদের সংস্থার মূল আদর্শ হল- অপরাধ যত ছোট বা বড়ই হোক না কেন, অপরাধ সম্পর্কে মিথ্যা বলা যাবেনা। প্রতিটি শিশুকে আমরা এটি শিখানোর চেষ্টা করি। বর্তমানে, ত্রিশটি শিশু আমাদের এনজিও থেকে বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
মহামারির সময় আমার ব্যবসায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় তিন মাস ধরে ব্যবসা বন্ধ ছিল। কোন বেচাকেনা না হলেও, আমাদের সংগঠন যেকোন অভাবগ্রস্ত শিশুর সহায়তায় সবসময় সচেষ্ট ছিল।ডিসেম্বরের দিকে ব্যবসার অবস্থা স্বাভাবিক হয়। তবে কোভিড -১৯ এর কারণে হওয়া ক্ষতি থেকে স্বাভাবিক হতে আমাদের অনেকটা সময় লেগেছে।
ব্রিন্তা জুটস নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মাঝে আছে ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করা এবং রপ্তানি বৃদ্ধি করা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য, আমি এমন কিছু যন্ত্রপাতি আমদানি করতে চাই যা শ্রমিকদের আরও বেশি পণ্য উৎপাদন করতে সহায়তা করবে। এতে শ্রমিকরাও বেশি আয় করতে পারবে এবং তাদের জীবনমানও উন্নত হবে। এখন আমাদের সাথে ১৫ জন নারীশ্রমিক কাজ করছেন এবং আমাদের এনজিও ৩০ জন শিশুকে সহযোগিতা করছে। আমি ভবিষ্যতে একশ জন শিশুকে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের স্বপ্ন দেখি। আমার ইচ্ছাগুলি পূরণ করতে আমি এক কোটি টাকা বিনিয়োগের খোঁজ করছি। সুদিন আসবেই এই অপেক্ষায় আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যেতে চাই৷