নারী ন্যাচারাল ক্রাফট
751 Views

আমি ঢাকা-ভিত্তিক একটি এনজিওতে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসাবে চাকরি করতাম। সেখানে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার সুবাদে, প্রায়ই নারী নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার খবর পেতাম। মহিলারা আমার কাছে এসে তাদের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নির্মম নির্যাতনের ঘটনাগুলো বলতেন। পরিবারের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হওয়ার কারণে তাদের এ অবস্থা থেকে বের হবার উপায় ছিলনা। তারা ছিলেন অসহায়, দুর্বল।

আমি যে এনজিওটির জন্য কাজ করতাম, তারা এই অরক্ষিত নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা দিচ্ছিল। তবে, এতে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছিল না। আমি এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলারা এনজিও থেকে যে অর্থ পায় তা তাদের স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির মানুষ জব্দ করে নেয়। আরেকটি ব্যাপার ছিল নারীদের ব্যবসার জ্ঞানের অভাব। পুরুষচালিত ব্যবসা অঙ্গনে নারীদের জ্ঞান ছিল সীমিত। ফলস্বরূপ, নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার বেশিরভাগ প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল।

এসব বিষয় আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল আমার “নারী” নামক উদ্যোগ চালু করতে। এ উদ্যোগ চেষ্টা করে নারীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করার। ২০১২ সালে রাবেয়া নামে এক অসহায় মহিলার সাথে আমার পরিচয় হয়, যার স্বামী তাকে ত্যাগ করেছিল। তাকে সাথে নিয়ে আমার “নারী” -র পথচলা শুরু। অর্থায়ন বা বিপণনের বিষয়ে তখন আমার জ্ঞান একেবারেই ছিলনা। তবে আমার মনে ছিল এই অবহেলিত নারীদের সহায়তা করার দৃঢ়় সংকল্প, যা আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায়। 

আমি এমন একটি ক্ষেত্রে কাজ করতে চাইছিলাম যা মহিলাদের চাকরির পথ সুগম করার পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধবও হবে। তখন আমি পাটের বিবিধ পণ্য তৈরির কথা ভাবি। কুড়িগ্রামের নারীদের সৃজনশীলতা এবং কারুশিল্পকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করি। অজানা এক পথে পাড়ি দিলেও, নিজের উপর ছিল আমার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। 

এই চলার পথে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, একজন উদ্যোক্তা হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। একটি-দুটি নয়, প্রতিটি পদক্ষেপেই ছিল কোন না কোন বাঁধা। আমি ছিলাম ঢাকার বাসিন্দা। তবে আমার কাজ আমাকে নিয়ে এসেছিল কুড়িগ্রামে, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর একটিতে। এখানে বাজার সংযোগ তৈরির কোন সুযোগই ছিলনা, কারণ ক্রেতারা এই দুর্গম অঞ্চলে আসতে চান না। প্রয়োজনীয় কাঁচামালগুলিও এখানে পাওয়া যেত না। আমাকে নিজেই কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা যেয়ে কাঁচামাল কিনে আবার কুড়িগ্রামে আনতে হত। কাজটি আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। মাঝে মাঝেই আমার মনে হত আমি আর পারবনা। কিন্তু অসংখ্য নারীর স্বপ্ন ও আশা আমার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই আমি থামিনি, থামতে পারিনি।

প্রায় এক দশক ধরে আমার উদ্যোগের যাত্রা চলছে। আমার জন্য সবকিছু ছিল একেবারেই নতুন, একেবারেই অজানা। নিঃসন্দেহে ভয় কাজ করত, তবে আমার উপর শত শত নারীর নির্ভরতাই আমার সাহস যুগিয়েছে। আমি ভবিষ্যতেও তাদের জন্য কাজ করে যেতে চাই। আমি আমার ব্যবসাটি সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা করছি, যার জন্য প্রয়োজন ৫০ লক্ষ টাকা। এ অর্থ দিয়ে আমি নতুন পণ্য বিক্রির পাশাপাশি আমার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারব। পাটের ব্যাগ, ফ্লোর ম্যাট, কোস্টার, ঝুড়ি প্রভৃতি আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বেশি বিক্রিকৃত পণ্য। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, দেশের বাইরেও রয়েছে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। আর্থিক সহযোগিতা পেলে আমি দেশের বাইরেও আমার ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হব।

আমার পণ্যগুলি প্রাথমিকভাবে বাণিজ্য মেলার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ধীরে ধীরে ক্রেতারা সরাসরি আমার কাছ থেকে পণ্য কিনতে শুরু করেন। আমি আমার ফেসবুক পেজ “নারী ন্যাচারাল ক্রাফট” এর মধ্য দিয়েও আমার পণ্য বিক্রি করে থাকি। পাশাপাশি, আমার ব্যবসার ওয়েবসাইট নির্মাণের কাজও চলছে। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলির মধ্য দিয়ে আমি ধীরে ধীরে নতুন ক্রেতার সন্ধান পাচ্ছি। আমি এসব প্লাটফর্মের মার্কেটিং সম্পর্কে শেখার চেষ্টা করছি যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি দেশ ও বিদেশের ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারি। বর্তমানে আমার ফেসবুকে ৫০০ মানুষের একটি কমিউনিটি আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই, আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।