দুর্জয় দুগ্ধ খামার
703 Views

বারো বছর আগে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে আমার সংসারে বেশ আর্থিক সংকট চলছিল।  আমার স্বামী ছিলেন একজন দুধবিক্রেতা। তিনি অন্যের খামারের দুধ বিক্রি করতেন। সন্তান হবার পর তার সামান্য আয়ে আমাদের খুব কষ্টে দিন কাটছিল। আমি ভাবলাম, আমরা নিজেরাই একটা খামার শুরু করব। আমার মধ্যে এক ধরণের জেদ চেপে বসল। আমি মনস্থির করে ফেললাম। যেভাবেই হোক আমি আমাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন আনবই। আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি ৬-৭ ভরির মত সোনার গহনা পেয়েছিলাম। আমি সেগুলি বিক্রি ১.৫ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি গাভী কিনলাম। সেদিন থেকে, আমার পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে।

২০১৭ সালে, মোট ৩ লক্ষ টাকা পুঁজি নিয়ে আমি দুর্জয় দুগ্ধ খামার শুরু করি। তারপর থেকে আমি, আমার স্বামী এবং আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মিলেই খামারটি পরিচালনা করছি। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পূর্বে গাভী পালার অভিজ্ঞতা ছিল। প্রথমে আমাদের গরু ছিল একটি। আমার স্বামী দুধ নিয়ে বিভিন্ন দোকানে, চায়ের দোকানে এবং শহরে বিক্রি করতেন। খুব দ্রুত আমরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে কুরবানির হাটে আমরা গরু বিক্রিও করেছি। বেশ দ্রুত আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। আমাদের খামারে গরুর সংখ্যা বেড়ে চলছিল। দেখতে না দেখতেই একটি থেকে পাঁচটি, পাঁচটি থেকে দশটি হয়ে গেল। গরুর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, এর কিছু সমস্যাও আছে।

গরুর সংখ্যা যত বেশি, গরু পালার খরচ ও খাটনি তত বেশি। আমাদের চারজনের জন্য দশটি গরুর লালন পালন করা এবং যত্ন নেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। মহামারি শুরু হওয়ার পরে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়, শহরে যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। তাই আমরা দুধ বিক্রি করতে পারিনি। গবাদি পশুর খাবারের দাম অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। নিজে না খেয়ে হলেও গরুর খাবার যোগাড় করতে হত। এক কেজি বিচালির দাম স্বাভাবিক সময়ে ৮০০-১০০০ টাকা, যা করোনাকালে ১০,০০০ টাকায় বিক্রি হত। মহামারিতে আমাদের প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। 

খামার ছাড়াও আমার শ্বশুরের জমিতে শাকসব্জি চাষ করতাম আমরা। করোনায় আমাদের চাষকৃত অনেক ফুলকপি অবিক্রিত রয়ে যায়। আমাদের সময় খারাপ যাচ্ছিল, তবুও আমরা আশা হারাইনি। আমাদের কিছু ছাগল ছিল, সেগুলি বিক্রি করে গরুর খাবার কিনেছিলাম। কুরবানির হাটে আমাদের কয়েকটি গরু বিক্রি করে দেই। বাজারে গরুর দাম ছিল অর্ধেক, কিন্তু টিকে থাকার তাগিদে বিক্রি না করে উপায় ছিল না।

যখন কারো ব্যবসার ক্ষতি হয়, স্বাভাবিকভাবেই তার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তবে, আমি জানতাম আমি হাল ছেড়ে দিতে পারিনা। আমি বিশ্বাস করি কর্মই মানুষকে বড় করে তোলে। পরিশ্রম ও ধৈর্য ছাড়া কোনো কাজেই সফল হওয়া সম্ভব নয়। এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে আমি দিন গুনতে থাকি। ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবসা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। এখন আমরা আবার নিয়মিত দুধ বিক্রি করতে পারছি। পাশাপাশি এই বছর আমাদের জমিতে বেশ ভাল করলা ফলন হয়েছে। 

আমার স্বপ্ন আমার খামারের দুধ দিয়ে আমি দুধ-জাতীয় সকল পণ্য উৎপাদন করব, যেমন ঘি, মাখন, দই, পনির ইত্যাদি। যাতে মানুষ আমাদের কাছ থেকে একবারে সব ধরণের দুধ-জাতীয় পণ্য কিনতে পারে। এর জন্য শুরুতে পাঁচ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, যা আমি ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার পরিকল্পনা করছি। আমি লাইটক্যাসল পার্টনার্স এর  ব্যবসায় প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম “উন্নতি”-র মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার প্রচেষ্টা করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাদের প্রোগ্রাম থেকে আমি ব্যবসার জ্ঞান ও দৈনন্দিন হিসাব রাখার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম৷ আমি ব্যবসার কৌশলগুলি কাজে লাগিয়ে, ভবিষ্যতে আমার খামারটি আরও বাড়িয়ে তুলতে চাই এবং পরিবারের সকলকে নিয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর এবং সমৃদ্ধ জীবন কাটাতে চাই।