Ashna Afroze, Prakriti Farming
প্রকৃতি ফার্মিং
3,108 Views

আমার ছেলের জন্মের পর, অন্য যেকোনো মায়ের মতো আমিও চেয়েছিলাম আমার সন্তানকে সবচেয়ে  পুষ্টিকর খাবারটি দিতে। তার জন্য সঠিক খাবারের সন্ধান করতে যেয়ে আমি বেশ দুঃখের সাথেই উপলব্ধি করলাম, ব্যাপারটা আসলে এত সহজ নয়। বলতে গেলে ভেজালমুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়ার তেমন উৎসই ছিল না। এছাড়া অর্গানিক ফুড বলে যে খাবার বিক্রি করা হয় তার গুণমান যাচাই করারও কোন উপায় ছিল না। বিষয়টি নিয়ে আমি খুব অসহায় বোধ করলাম। তখন আমার মনে হল, আমি একা নই, আমার মত এ দেশে আরো হাজারো মা আছেন, যারা একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। আমি ভাবলাম হয়তো এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমি কিছু করতে পারি। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি প্রকৃতি ফার্মিং শুরু করার কথা ভাবি, যেখানে মানুষ ক্ষতিকারক কেমিকেল নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে খাঁটি ও নির্ভেজাল খাবার কিনতে পারবে। 

 ২০১৭ সালে একটি ছাদ-বাগানের মধ্য দিয়ে আমার প্রাথমিক যাত্রাটি শুরু হয়। যেহেতু ছাদ-বাগান, শুরুর দিকে খুব কম উৎপাদন করতে পারতাম। সময়ের সাথে সাথে আমার ব্যবসা ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে, প্রায় ৩০০ জন কৃষক আমার জন্য কাজ করছেন। আমার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ কৃষকদের জীবনমান ব্যাপকভাবে উন্নত হচ্ছে। পূর্বে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত বাজারের সাথে সরাসরি যোগাযোগের কোন উপায় তাদের ছিলনা। তাই তারা কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম পেতেন না। প্রকৃতি ফার্মিং এর মধ্য দিয়ে তারা এখন সঠিক দামে ঢাকার বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন। এতে তাদের আর্থিক ও সার্বিক উন্নতি হচ্ছে। তবে ছাদ-বাগান পরিচালনা থেকে ৩০০ জন কৃষকের নেটওয়ার্ক তৈরির এ পথ মোটেও সুগম ছিলনা। অসংখ্য ব্যক্তি, বেশ কিছু এনজিও ও অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা ছাড়া আমি কখনোই এতদূর আসতে পারতাম না। 

ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাঁধা ছিল প্রচুর। যদি আমি তালিকা করতে বসি, সারাদিনেও শেষ হবেনা। তবে কিছু লড়াই বাকিগুলোর চেয়ে একটু বেশি কঠিন ছিল। আমি যখন পেছন ফিরে দেখি আর আজকের দিনে তাকাই, আমি গর্ববোধ করি। একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হয়েছিলাম যখন স্থানীয় কৃষকদের আমার ব্যবসায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি টাঙ্গাইলের একটি কৃষক সম্প্রদায়ের কাছে যাই। তাদের সাথে ব্যবসা করার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই পুরুষ-তান্ত্রিক। তাই আমার মতো শহুরে নারীর জন্য ভিন্ন এলাকা থেকে এসে, তাদের সাথে নিয়ে ব্যবসা করা এবং তাদেরকে কাজের নির্দেশনা দেওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। তাদের মানসিকতা বোঝার জন্য আমাকে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। এখন এই কৃষকরাই আমার ব্যবসার সবচেয়ে বড় শক্তি। আমি তাদের কাজের মানের উপর আস্থা রাখতে পারি এবং তারাও আমার উপর নির্ভর করতে পারে। একটি সফল ব্যবসার জন্য এই বিশ্বাস থাকাটা পূর্বশর্ত বলে আমি মনে করি।

মহামারিতে আমি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলাম। বিশ্বব্যাপী সমস্ত ব্যবসায়ের স্থবিরতায় এনেছিল করোনা মহামারি। আমার ব্যবসাও আলাদা ছিল না। লকডাউনে প্রথম কয়েক মাসের জন্য, বেচাকেনা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, ধীরে ধীরে আবার অর্ডার আসতে শুরু করে। কিন্তু গ্রাহকদের কাছে পণ্য সরবরাহ করার জন্য ডেলিভারির লোক পাওয়া যাচ্ছিলনা। মহামারির অনিশ্চিত সময়ে সবার মনে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ডেলিভারির লোকেরা ঘরে ঘরে যেয়ে খাবার পৌঁছে দিতে চাইতেন না। মাঝে মাঝে লোকের অভাবে আমাকে পণ্যগুলি নিজেই পৌঁছে দিতে হয়েছিল। তবে আমার ব্যবসার উপযোগিতাই আমাকে এই কঠিন সময়ে টিকে থাকতে সহায়তা করে। যখন লকডাউন শুরু হয়, আমি তৎক্ষণাৎ আমার ব্যবসাটি অনলাইনে নিয়ে আসি। রাতারাতি পরিবর্তন আনলেও আমরা বেশ ভালভাবে সামলেছিলাম। এই পরিস্থিতিগুলি আমাকে সাহসিকতা ও সহনশীলতার শক্তি সম্পর্কে শিখিয়েছে। যার কারণে আমি আমার কল্পনার বাইরেও আমার ব্যবসাকে বাড়িয়ে তুলতে পেরেছি। 

জীবন কোনও রূপকথার গল্প নয়। তাই এমনও সময় আসে যখন আমি হতাশ হই।  যখন আমার মনে হয় আমি আর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবনা। এই সময়গুলিতে আমি আরও কিছুদূর এগোবার জন্য নিজেকে জোর দিই। আজ, আমি আনন্দিত। কারণ আমার খুব কঠিন পরিস্থিতিতেও আমি থেমে যাইনি, আমার স্বপ্নগুলোকে অপূর্ণ থেকে যেতে দেইনি। আমি এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে খাদ্য খাতে মহিলা উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথম পুরষ্কারের বিজয়ী।

আমার ব্যবসার বৃদ্ধির সাথে সাথে আমি বিনিয়োগকারী এবং পরামর্শক সংস্থাগুলির সাথে যোগাযোগ করা শুরু করি। এভাবেই লাইটক্যাসল পার্টনার্স এর সাথে আমার পরিচয়। আমার কাছে লাইটক্যাসল পার্টনার্স আমার পরিবারের মতো। তারা ব্যবসার শুরু থেকেই আমাকে সমর্থন করে এসেছে। তাদের মাধ্যমে আমি বাংলাদেশ নিউট্রিস্টার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানতে পারি এবং পুরস্কৃত হই।

আমাদের দেশের গ্রাহকরা দিন দিন স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠছেন। তাই অর্গানিক খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। তবে, খাদ্য সামগ্রীর বাজার অত্যন্ত স্যাচুরেটেড। তার উপর আমার পণ্যগুলি খাঁটি কিনা তা যাচাই করার জন্য কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। তাই ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য আমাকে বিপণনের উপরই খুব বেশি নির্ভর করতে হয়। আমি আমার পণ্যগুলির বিপণনে আরও বেশি বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছি। এতে প্রকৃতি ফার্মিং এর দ্রুত সম্প্রসারণে এবং একটি স্বাস্থ্যকর বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাকে অনেক সহায়তা করবে।