Monowara Begum, Khulna
নিরাপদ সবজি
1,283 Views

আমার জীবনের অনেকটুকু সময়ই কেটে গেছে বিচিত্র রকমের অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। ২০০১ সাল থেকে আমি হাঙ্গার ফ্রী ওয়ার্ল্ডের সাথে যুক্ত ছিলাম। তাদের মূল লক্ষ্য হল নিরাপদ ও টাটকা সবজি সবাই যেন খেতে পারে তা নিশ্চিত করা। সেখানের সেন্টার ফর অর্গানিক ফার্ম থেকে আমি ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে সতেজ শাক-সবজি উৎপাদনের পদ্ধতি জানতে পারি। আমি স্থানীয় কৃষি অফিসের সাথে কাজ করে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারের জন্য সবাইকে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তীতে, ২০০৭ সালে ‘নিরাপদ সবজি’ দিয়ে আমার ব্যবসায়িক জীবনের সূচনা হয়।

উদ্যোক্তা হওয়ার ঝুঁকি এবং সীমাবদ্ধতা জানা সত্ত্বেও, আমি এই অজানা পথে পা রাখি। প্রথমদিকে আমার কার্যক্রম খুবই সীমিত পরিসরে ছিল। মানুষ তাদের কৃষিকাজের পদ্ধতি পরিবর্তন করার জন্য কোন উৎসাহ পাচ্ছিলনা। আমি তাদের সার ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী অপকারিতা এবং প্রাকৃতিক কম্পোস্টের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছিলাম আমার প্রশিক্ষনের মাধ্যমে। আমি চেয়েছি গৃহিণীরা এবং নারীরা তাদের বাড়ির উঠোনে বা ক্ষেতে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল এবং শাকসবজি চাষ করুক যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। এক এক করে তারা আমার সাথে কাজ করার আগ্রহ পায় এবং সবকিছু শিখতে থাকে।  

প্রথমদিকে আমার ভার্মি কম্পোস্ট বিক্রি খুব কম ছিল। কৃষকরা ভার্মি কম্পোস্ট বা রাসায়নিক সার যেটাই ব্যবহার করুক না কেন বাজারে সবজির দাম একই ছিল। সুতরাং, তাদের  ভার্মি কম্পোস্ট কেনার প্রতি কোন আগ্রহ  ছিল না। সেজন্য সেন্টার ফর অর্গানিক ফার্ম থেকে শাহিন হোসেন ঢাকায় আমাদের সবজিগুলো বিক্রির পরামর্শ দেন। তিনি প্রকৃতি ফার্মের কিছু প্রতিনিধির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছিলেন, যেখানে তারা প্রত্যেকের জন্য, বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং প্রাকৃতিক সবজি ও খাবার বিক্রি করে। আমরা দ্রুত তাদের শীর্ষ সরবরাহকারীদের একজন হয়ে গেলাম। তাছাড়া, কৃষি অফিস প্রথম দিন থেকেই আমাদের নিরলস সহযোগিতা দিয়ে গেছে। তারা আমাদের সমর্থন দিয়েছিল যাতে আমরা আরও অনেককে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করতে এবং বিষমুক্ত সবজি খেতে অনুপ্রাণিত করতে পারি। ব্যাবসাইক সাফল্যের পাশাপাশি আমার ২০ বছরের সামাজিক কর্মকাণ্ডের কারণে, আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি; যেমনঃ খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার, হাঙ্গার ফ্রী ওয়ার্ল্ড পুরস্কার, এলজিইডি পুরস্কার, এবং বঙ্গবন্ধু পুরস্কার। 

আমরা এখন ৬০০ এরও বেশি মহিলা উদ্যোক্তাদের একটি বৃহৎ পরিবারে পরিণত হয়েছি যারা নিয়মিত প্রাকৃতিক কম্পোস্ট ব্যবহার করে ভেজালমুক্ত সবজি চাষ করে। আমরা প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমার বাড়ির আঙ্গিনায় হাটের আয়োজন করি যেখানে আলু, পেঁপে, কুমড়া, লেবু, কলা, বিভিন্ন ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে থাকি। শুধু অলস বসে থাকা বা গৃহস্থালি কাজ করার পরিবর্তে মহিলারা এখন প্রতি মাসে ২০০০০ এরও বেশি উপার্জন করতে পারে। আমাদের ব্যবসা বৃদ্ধি অনেক ভালোভাবে হচ্ছিলো, কিন্তু করোনা মহামারীর আঘাতে আমরা বেশ পিছিয়ে গিয়েছি।

২০২০ সাল আমাদের জন্য খুব কঠিন সময় ছিল। শহরের বাজার থেকে অর্ডারের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং স্থানীয় বাজারের অবস্থাও নাজেহাল হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, কম দামে বিক্রি করা এবং ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। বর্তমানে, পরিস্থিতি ভাল হতে শুরু করেছে এবং দামও বাড়ছে। আমরা আশাবাদী যে আমাদের আর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না।

লাইটকাস্টল পার্টনার্সের আয়োজনে যশোরের ট্রেনিং প্রোগ্রামটি সংক্ষিপ্ত হলেও খুবই কার্যকরী ছিল। যদিও আমি ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিজের ব্যবসা করছি, ব্যবস্থাপনা এবং মার্কেটের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনেক নতুন বিষয় শিখতে পেরেছি। এখন, আমরা নিরাপদ সবজির সাথে একটি গরুর খামার শুরু করে আমাদের ব্যবসাকে বৈচিত্র্যময় করার পরিকল্পনা করছি। আমরা গরু থেকে কম্পোস্ট পাব যার ফলে অন্যদের থেকে আর তা কিনে আনার প্রয়োজন পড়বে না। তাই আমাদের লক্ষ্য সর্বশক্তিমানের প্রতি বিশ্বাস বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া।