উৎসব সিড ফার্ম
974 Views

আমি যশোরে একটি এনজিওতে ১৯ বছর কাজ করেছি। আমার স্বামীর ফুল ও বীজের ব্যবসা ছিল। মাঝে মাঝে সময় পেলে আমি তার ব্যবসার টুকটাক সহযোগিতা করতাম। ২০০৬ সালে আমি যে প্রজেক্টটিতে কাজ করছিলাম, সেটি শেষ হলে আমাকে দিনাজপুরে আরেকটি প্রজেক্টের কাজে বদলি করা হয়। আমার শ্বাশুড়ি সে সময় খুব অসুস্থ ছিলেন। আমি ছাড়া তাকে দেখভাল করার কেউ ছিলনা। আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম এবং বীজের ব্যবসার দায়িত্ব নিলাম। এভাবেই আমার ব্যবসায়ী জীবনের শুরু।

আমি যখন বীজ ব্যবসায় নামলাম, গ্রামের লোকেরা নানান কথা বলত। ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে মহিলাদের ব্যবসা করা তাদের চোখে ভাল কিছু ছিলনা। অনেকে আবার মনে করতেন নারীরা বীজ সংরক্ষণের কাজ ভালোভাবে করতে পারে না। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা যখন আমার পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে জানতে পারে, তারাই আমার কাছে বীজ কিনতে আসে। এখন তাদের কাছ থেকে আমি আমার কাজের প্রশংসা পাই। 

প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে বীজের ব্যবসা শুরু করি। আমাদের বীজগুলি যশোর, সাতক্ষীরা, ডুমুরিয়া ও খুলনার অন্যান্য এলাকার কৃষকের কাছে বিক্রি হয়। অনেক ধরণের বীজ এর মধ্যে ধানের বীজই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। যেহেতু ধান আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ফসল, এর বীজের চাহিদা সবসময়ই থাকে। তবে কোন জাতের ধানের বীজ বেশি বিক্রি হবে তা নির্ভর করে বাজারের চাহিদার উপর। 

ব্যবসা যে সবসময় খুব ভাল চলছিল, তা নয়। ২০০৯ সালে আলুবীজ বিক্রি করতে যেয়ে আমাদের বেশ ক্ষতি হয়। বাজার চাহিদা কম থাকার কারণে ১৫০০ বস্তা আলুবীজ অবিক্রিত রয়ে যায়। এরপর থেকে আমরা আর আলুবীজ বিক্রি করিনা। এরপর ২০১১ সালে আমার প্রায় ১০ টন বিরি-৫০ বা বাসমতি বীজের আবাদ ছিল৷ কিন্তু জার্মিনেশন ঠিকমত না হওয়াতে আমি সেগুলি বীজ আকারে বিক্রি করতে পারিনি। ফলে আমার বিশাল ক্ষতি হয়। ব্যবসার মেরুদণ্ড বলতে গেলে ভেঙেই গিয়েছিল। এরকম অনেক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে, তবে আমরা বারবার উঠে দাঁড়িয়েছি।

সত্যি বলতে, বীজ ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। অর্থের যোগান এ ব্যবসায় একটি বড় সমস্যা। বীজের একটি ভাল বাজার স্থাপন করতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন হয়। এছাড়া বীজের জার্মিনেশন-জনিত সমস্যা লেগেই থাকে। তার উপর, বীজের ব্যবসা মৌসুমভিত্তিক। কোনো মৌসুমে ব্যবসার ক্ষতি হয়ে গেলে সেই ক্ষতি থেকে উঠে দাঁড়াতে প্রচুর ধৈর্য ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। 

বীজের পাশাপাশি আমরা ফুল চাষও করতাম। করোনাকালে ফুলের ব্যবসার মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ ২০১৯ সাল থেকে আমাদের কোনো ফুল বিক্রি হয়নি। ফুল তুলে আনছি, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফেলে দিচ্ছি। ২০২০ সালে আমফান ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ফুল বাগানের শেড ভেঙে যায়। সামগ্রিকভাবে আট লক্ষ টাকার মতন ক্ষতি হয়৷ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমি ব্যাংক থেকে দুই লক্ষ টাকা লোন নিয়েছি। ধান চাষের মৌসুমে কৃষকদের বীজ কিনতেই হয়েছে। তাই লকডাউনে বীজ ব্যবসা সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

বীজ ব্যবসা করার কারণে আমি এফসিডিআই (ফ্লাড কন্ট্রোল ড্রেনেজ এন্ড ইরিগেশন) প্রজেক্ট এর সাথে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত ছিলাম। সেখান থেকে আমি লাইটক্যাসল পার্টনার্স সম্পর্কে জানতে পারি। ২০১৯ সালে তাদের আয়োজিত একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে আমি মূলধনের সঠিক প্রয়োগ ও বাজার সৃষ্টির বিভিন্ন পথ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করি। করোনার দুঃসময় পার করতে পারলে এই পথগুলো কাজ লাগানোর কথা চিন্তা করছি। সামনে অক্টোবর মাসে চাষের মৌসুম। এই মৌসুমে বীজের ব্যবসা ভালভাবে হলে আবার আমরা একটু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব।

আমার ব্যবসাটিকে প্রসারিত করবার স্বপ্ন আমার অনেকদিনের। আমার পণ্যগুলো যাতে সারা দেশে পৌঁছাতে পারে, তাই আমি একটি বড় ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে চাই। এতে মানুষের জন্য কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি করতে পারব। তাছাড়া কৃষিপণ্য ব্যবসায় নারীদের সংশ্লিষ্টতা তুলনামূলক কম। আমি আশা করি একদিন অসংখ্য নারী আমাকে দেখে অনুপ্রানিত হবে। বেশ বড়সড় একটি স্বপ্ন আমার, বাস্তবায়ন করতে কমপক্ষে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। তবে আমার কল্পনাকে সত্যি করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাব।