Shahnaj Parveen, Jessore
আলিফ এন্টারপ্রাইজ
1,247 Views

বিয়ের আগে আমি শরীয়তপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ২০০০ সালে বিয়ের পর শিক্ষকতা ছেড়ে আমার স্বামীর সাথে যশোরে চলে আসতে হয়। এখানে এসে গৃহিণীর দায়িত্বই পালন করছিলাম। আমার স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৫ সালে তার ইংল্যান্ডে যাওয়ার একটি সুযোগ আসে। কোম্পানির চাকরি, তাই সবকিছু ঠিক হওয়ার এক মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু তার যাওয়া পেছায়। রোজগারও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে এসে আমরা বুঝতে পারি, সুযোগটি ভুয়া ছিল। আমরা যা টাকা দিয়েছিলাম আর ফিরে পাইনি।

স্বামী ঘরে বসার পর থেকে পরিবার চালানোর জন্য আমি বিভিন্ন আয়ের উপায় খুঁজতে থাকি। আমার শ্বশুরের জমিতে বেশ ভাল আমের বাগান হত। গ্রীষ্মকালে তারা আম পাঠালে আমি আশেপাশের প্রতিবেশীদের খেতে দিতাম। একদিন এক প্রতিবেশী আমার কাছ থেকে ৫ কেজি আম কিনতে চাইল। আমি অপ্রস্তুত ছিলাম। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে আমের দাম নির্ধারণ করব। ৫ কেজি আম মাপার মত কোন বাটখারা বা মেশিন আমার ছিলনা। নাম মাত্র দাম রেখে, আমি তাকে অনুমান করে ৫ কেজির চেয়ে একটু বেশি আম দিলাম।

আমার সেই প্রতিবেশীর আম খুব ভাল লেগেছিল। তার প্রশংসা শুনে আশেপাশে আরো অনেকে আমাদের আম কিনতে আগ্রহী হয়। আমাদের আমে কোন ফরমালিন দেওয়া হতনা। আমরা দেখলাম আমের প্রচুর চাহিদা। তাই আমরা আরো আম আনার কথা ভাবলাম। আমি আমাদের আম বাগান থেকে এক মণ আম আনাই। আশ্চর্যের বিষয়, একদিনের মধ্যেই সব আম বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আমি আরো আম আনিয়ে বিক্রি করতে থাকি। এভাবে আমি হয়ে উঠি আম ব্যবসায়ী। কিন্তু আমের ব্যবসা ছিল মৌসুমভিত্তিক। আমাদের আয়ের স্থায়ী উৎসের প্রয়োজন ছিল।

২০১৮ সালের দিকে, আমি আমার ছেলের স্কুলের একজন অভিভাবকের মাধ্যমে ঢাকার বিবিয়ানা ফ্যাশন হাউস এর কিছু নকশা করার কাজ করার পাই। যখন আমার ছেলে ছোট ছিল, আমি কিছু হাতের কাজ শিখেছিলাম। সেই দক্ষতাকে কাজে লাগাতে আমি বিবিয়ানার কাজটি নেই। এরপর আস্তে আস্তে বুটিকের ব্যবসা শুরু করি। ৫০,০০০ টাকা পুঁজি নিয়ে আমি রত্না বুটিক শুরু করেছিলাম। আমি বাসা থেকেই জামাগুলি বিক্রি করতাম, মাঝে মাঝে ছেলের স্কুলে যেয়ে বিক্রি করতাম। কিন্তু আমার ব্যবসা তেমন ভাল চলছিলনা। আমার হিসাব-নিকাশ করার জ্ঞান তেমন ছিলইনা। কাপড়ের ব্যবসায় প্রতিযোগিতা ছিল প্রচুর। সবার পুঁজি ছিল অনেক। কেউ কেউ ভারত থেকে আমদানি করে জামা বিক্রি করতেন, কারো অথবা ফ্যাক্টরির সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। আমার কোনোটাই ছিলনা।

আমার ব্যবসায় লাভ হচ্ছিলনা। আমি অর্থের অভাবে ঠিকমত ব্যবসার প্রসারও করতে পারছিলাম না। মানুষ চিনতেও ভুল করছিলাম। একবার আমি একজন সাপ্লায়ারকে ৩০,০০০ টাকা দেই। তারপর সে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কাকে বিশ্বাস করব, বুঝতে পারছিলামনা।

মহামারি আমার জন্য ভয়ংকর একটি সময় ছিল। বিশেষ করে আমার আমের ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতি হয়। করোনার আগে আমের ব্যবসাটি বেশ লাভজনক ছিল। ঢাকার সুপারশপ ‘স্বপ্ন’ আমাদের কাছ থেকে আম নিতেন। তাই আমরা আশেপাশের আরো কিছু আমের বাগান লিজ নিয়েছিলাম। করোনার কারণে লকডাউন তো ছিলই, তার উপর ঘূর্নিঝড় ‘আমফান’ আমাদের সব আম নষ্ট করে দেয়। সব গাছ ভেঙে পড়ে। গত বছর আমাদের ৫ কেজি আমও বিক্রি হয়নি। সব মিলিয়ে আমাদের মোট ১০ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়।

এত টাকা ক্ষতি হবার পর, আমাদের আর বুটিক এর ব্যবসাটা চালানোর কোন মানসিক শক্তি বাকি ছিলনা। আমি এবার এমন কিছু নিয়ে ব্যবসা করতে চাইছিলাম যেটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে একটি। যে ব্যবসায় টাকাও কম লাগবে, অন্যের উপর নির্ভরও করতে হবেনা। ভেবে বের করলাম, মশলার ব্যবসা করব। প্রতিটি পরিবারেই প্রতিদিনের খাবারে কোন না কোন মসলার ব্যবহার হয়। এই বছর থেকে আমি বাজার থেকে পাইকারি দামে মরিচ, আদা, হলুদ, জিরা, কালোজিরা, লবঙ্গ, এলাচি ইত্যাদি কিনে এনে বাসায় মসলা গুড়া করে বিক্রি করি। মাঝে মাঝে আমি জামাও বিক্রি করি, তবে মসলার ব্যবসা এখন আমার সবচেয়ে চাঙ্গা ব্যবসা। আমি এই মসলার ব্যবসার নাম ঠিক করেছি ‘আলিফ এন্টারপ্রাইজ’।

নতুন কিছু শেখার বা জানার ইচ্ছা আমার সবসময়ই ছিল। সুযোগ পেলেই আমি বিভিন্ন ট্রেনিং সেশন করতাম। সেই সুবাদে একজন ট্রেইনার আপার সাথে আমার ভাল সম্পর্ক হয় এবং তার মাধ্যমে আমি ২০১৯ সালে লাইটক্যাসল পার্টনার্সের একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে যুক্ত হয়েছিলাম। আগে আমি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ এর ধারণা সম্পর্কে জানতাম না। এ ট্রেনিং থেকে এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরে আমি উপকৃত হয়েছি। এখন আমি যেকোন কাজ শুরুর আগে খরচের হিসাবটা করি।

আমরা এখনো বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আমার বর্তমান ব্যবসাটিকে বড় করতে চাই। আমার খুব মন খারাপ হয়। আমাদের এখনো কোন আধুনিক মসলা গুড়া করার যন্ত্রপাতি নেই। আমি আর আমার স্বামী হামানদিস্তায় সব মসলা নিজ হাতে গুড়া করি। ১-১.৫ লক্ষ টাকা যোগাড় করতে পারলে আমরা একটা ভাল মানের গ্রাইন্ডার কিনতে পারব। যদি সবকিছু ভালমত যায়, আমরা স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতে নিজেদের একটি মশলার মিল দেওয়ার, সকল পরিবারের কাছে আমার মশলা পৌঁছে দেওয়ার।