Mahbuba Islam, Dhaka
আর ফুড প্রোডাক্টস
1,521 Views

ঢাকায় আমার বেড়ে উঠা হলেও স্বামীর চাকরির কারণে আমাকে চট্টগ্রামে থাকতে হয়েছিল। বিয়ের পর থেকেই রান্নাবান্নার বেশ শখ জাগে আমার। আমার ছেলে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠল, তাকে আমার বেশ একটা সময় দিতে হত না। আমি তখন রান্নার ব্যাপারে মনোযোগ দেই। প্রথমে আমি কুকিং কোর্স করাবো বলে মনস্থির করি। অনেকটাই ব্যবস্থা করে ফেলি, লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণও করি। তারপর হঠাৎ করেই আমি দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে চলি। তারপর আমার আর কুকিং কোর্স করানো হয়ে উঠেনা। কিন্তু রান্নাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার স্বপ্নটা আমার মনে রয়ে যায়। 

বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। আমার বাচ্চাটা একটু বড় হলে তাকে আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করি। আমি লক্ষ করি, সেখানের ক্যান্টিনটা তেমন যত্ন করে কেউ চালাচ্ছেনা। মোটামুটি পরিত্যক্ত অবস্থায়ই পড়ে আছে। আমি প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে জানতে চাই এই অবস্থার কারণ কি। তিনি আমাকে বলেন, বেশ কয়েক জনই ক্যান্টিনটি চালানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু কেউই ছয় মাসের বেশি টিকতা পারেনি৷ আমি তাকে বললাম আমি চেষ্টা করে দেখতে চাই। তিনি রাজি হলেন।

স্কুলটিতে তখন ৪০০-৫০০ জনের মত বাচ্চা পড়ত। আমি ক্যান্টিনটি চালু করি এবং ভাল সাড়া পাই। বেশ কিছুদিন পর আমার সাথের মহিলা কারিগর আমাকে একটা ভাল উপদেশ দেন। তিনি অন্যান্য স্কুলে ক্যান্টিনে কাজ করার সময় দেখেছিলেন যে তারা ক্যান্টিনের খাবার আইটেম গুলি ফ্রোজেন ফুড আকারে বিভিন্ন সুপারশপের কাছে বিক্রি করেন। আমি ভাবলাম আমিও চেষ্টা করে দেখি৷ সেই সময় আমার বাসার সামনেই নতুন মীনা বাজারের আউটলেট খুলে। আমি তাদের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তাদেরকে ফ্রোজেন ফুড দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানি। এরপর তার পরামর্শ অনুসরণ করে, ট্রেড লাইসেন্স করে আমি শুরু করি আমার ফ্রোজেন ফুড এর ব্যবসা। আমার দুই সন্তানের ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর ‘আর’ দিয়ে শুরু, তাই ব্যবসার নাম দেই আর ফুড প্রোডাক্টস।

আমি মীনাবাজারে প্রথম আমার ফ্রোজেন ফুড বিক্রি শুরু করি। আস্তে আস্তে অন্যান্য সুপার শপেও খাবার বিক্রি শুরু করি। পাশাপাশি আমি দুইটি স্কুল ক্যান্টিন এবং ইস্ট ডেল্টা নামে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনও চালিয়েছি। প্রায় ১৫ বছর হয়ে গেছে আমার ব্যবসার। আমার স্বামী বরাবরই আমাকে সহযোগিতা করে গেছেন। তিনি ৯-৫ টা চাকরির ব্যপারে কখনোই সায় দিতেন না। তবে রান্নার ব্যবসায় তিনি সবসময় পাশে ছিলেন।

সব ব্যবসার পথেই অনেক বড় বড় কাঁটা পেরোতে হয়। তবে আমার ব্যবসার শুরুর দিকটা মোটামুটি তেমন সমস্যা ছাড়াই পার করে ফেলেছিলাম। বিয়ের আগে আমার রান্নাঘরে পা দেওয়া হত না। বিয়ের পরেই আমার রান্না নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। সেই সময়ে এখনকার মত রান্না শেখার এত সু্যোগ সুবিধা ছিলনা। ইউটিউব ছিলনা, ভিডিও ক্লাস ছিলনা। কুকিং স্কুল গুলোতে ভর্তি হয়ে হাতে কলমে রান্না শেখাই ছিল একমাত্র উপায়। বেশ কষ্ট করেই আমাকে রান্না শিখতে হয়। আমি ভেবেছিলাম ফাস্টফুডের ব্যবসা করব কিন্তু শেষমেশ ফ্রোজেন ফুডের ব্যবসায়ই মন দিলাম।

মীনা বাজারের সাথে আমার ব্যবসার যাত্রা শুরু। তাই তাদের সাথে আমার একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের মাধ্যমে আমি লাইটক্যাসল পার্টনার্স এর সাথে পরিচিত হই। আমি তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নেই এবং বেশ ভাল একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করি। চট্টগ্রাম ছিল আমার অস্থায়ী বাসস্থান। আমি জানতাম কিছুদিন পর আমরা ঢাকায় ফেরত আসব। তাই আমি পুরোপুরি ব্যবসার প্রসারের পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছিলাম।

দুই বছর আগে আমার স্বামী ঢাকায় ট্রান্সফার হলে আমরা এখানে চলে আসি। এবার আমি নতুন করে আমার সবকিছু দিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করা শুরু করি। তখনই মহামারি আঘাত হানে। করোনার কারণে সবকিছু পিছিয়ে যায়। আমার কর্মচারীদের আমি পুরোটা সময় বেতন দিয়ে গেছি। সবমিলিয়ে আমার মোট ৮-১০ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। বেশ বড় একটা ক্ষতির মুখে ছিলাম আমি৷ কিন্তু আমি হার মানতে রাজি নই। এখন লকডাউন শিথিলের পথে, তাই আস্তে আস্তে আমি আবার সব একদম নতুন করে শুরু করব।

সব উদ্যোক্তাদের মতই আমিও চাই আমার পণ্যগুলি সবার কাছে পৌঁছাক। সুপার শপের পাশাপাশি, আমি একটা দোকান ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করছি। যেকোনো মূল্যেই আমি আমার ব্যবসাটিকে আবার দাঁড় করাব। দোকানের ভাড়া এবং অন্যান্য শর্তগুলি মিলাতে পারলেই আমি নূতন উদ্যমে আমার ব্যবসাকে সফল করার উদ্দেশ্যে কাজে নেমে পড়ব।