২০১৫ সালে আমার ছেলের বয়স যখন তিন বছর, তখন আমার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। আমার বিচ্ছেদের পর, পরিবারের কারো কাছ থেকে আমি কোনো ধরণের সমর্থন পাইনি। আমার একটি চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। একটি চাকরির প্রস্তাব পাই যেখানে তারা আমাকে আবাসনের সুবিধা দেওয়ার কথা বলে। আমি তাই বাসা ছেড়ে দিই আর আমার সব আসবাবপত্র একজনের আমানতে রেখে আসি। অবশেষে দেখা যায়, চাকরিটি আসলে প্রতারণা ছিল। পাশাপাশি আমি যাদের কাছে আমার আসবাব রেখে আসি, তারা জানায় আমার সমস্ত আসবাব চুরি হয়ে গেছে। আমাকে আমার ছেলেসহ রাস্তায় নেমে যেতে হয়। দিনের বেলা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হত, রাতে একেক দিন একেক আত্মীয় অথবা বান্ধবীর বাসায় থাকতাম। এখনো সেই দিনগুলির কথা চিন্তা করলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
ইতোমধ্যে আমার এক বন্ধু আমাকে কল সেন্টারে চাকরি যোগাড় করে দেয়। সেই বেতন দিয়ে অবশেষে একটা বাসা ভাড়া নেই। সন্তানকে ডে-কেয়ার সেন্টারে দিয়ে চাকরিতে যেতাম। কিন্তু চাকরির ব্যস্ততা ছিল এত যে ডে-কেয়ার এর সাথেও সময় মেলাতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে চলবেনা। আমাকে এমন কিছু উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে আমি একই সাথে আমার ছেলের যত্ন নিতে পারি এবং অর্থ উপার্জন করতে পারি।
আমার এক বান্ধবী অনলাইন ব্যবসা করত। সে জানত আমি ভাল রান্না পারি। সে আমাকে অনলাইনে ফ্রোজেন ফুড এর ব্যবসা শুরু করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু আমার তখন কোনো টাকাই ছিলনা। ফ্রিজ দূরের কথা, আমার নিজের চুলাও ছিলনা। আমার কাছে ছিল কেবল ৫০ টাকা৷ আমার বান্ধবী আমাকে আরো কিছু টাকা দেয়। তাই দিয়ে আমি একটা মুরগি আর ২.৫ কেজি আলু কিনে আনি। আমার প্রতিবেশীর রান্নাঘর ব্যবহার করে কয়েকটি মুরগির আইটেম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং আলুর চপ তৈরি করি। আল্লাহর রহমতে আমার ফেসবুক পেজ থেকে বেশ ভাল সাড়া পাই।
ধীরে ধীরে আমি আরও অর্ডার পেতে শুরু করি। তখন আমার বান্ধবী আমাকে তার বাসায় রান্না করে তার ফ্রিজ ব্যবহার করতে বলে। আমার বিকল্প কোন উপায় ছিলনা। তাই আমি তার বাসায় যেয়ে রান্না শুরু করি। সেই সময়, আমি আমার অর্ডারগুলি নিজেই ডেলিভারি করতাম। ছয় মাস এভাবে চালানোর পরে, আমি ডেলিভারিম্যান দিয়ে ডেলিভারি দেয়া শুরু করি। তারপর আমার কিছু টাকা আর বান্ধবীর থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে একত্রে মিলিয়ে একটা ডিপ ফ্রিজ কিনি। অবশেষে আমি আমার নিজ বাসা থেকে আমার পণ্য বিক্রয় করতে শুরু করি।
ফ্রোজেন ফুড থেকে আস্তে আস্তে আমি রেডি ফুড আইটেম গুলি বিক্রি শুরু করি। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার এমনকি রমজানের ইফতারিও বিক্রি করেছি। ২০১৭ সালে, আমি রাজশাহী এবং দিনাজপুর থেকে আমার কিছু আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে বাগান থেকে আম ও লিচু নিয়ে এসে বিক্রি করা শুরু করি। প্রথমে আমি তাদের কাছ থেকে কিনি, সেগুলি খুবই নিম্নমানের ছিল। আমার আট মণ আমের টাকার পুরোটাই নষ্ট হয়। আমার ভিষণ মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এর পরে আমি আরেকটি লিঙ্ক থেকে আম আনাই। এখন পর্যন্ত আমি আমার আমের কোনও বাজে রিভিউ পাইনি।
আমাদের সমাজে একা মায়েদের জন্য জীবন এমনিতেই কঠিন। তার উপর আমার ছিল না পরিবারের কোনো সমর্থন। আমার বাবা খাবারের ব্যবসা করার ধারণাটি ভালো চোখে দেখেন না। আমার অনেক আত্মীয় আমার ব্যবসা সম্পর্কে খুব বাজে বাজে মন্তব্যও করেছেন। আমি কখনই তাদের নেতিবাচক সমালোচনায় দমে যাইনি। কারণ আমি সম্পূর্ণ সততার সাথে মানুষকে টাটকা খাবার সরবরাহ করছি। এই ব্যবসার জন্য, আমি বাসায় বসে আয় করতে পারছি এবং একই সাথে আমার বাচ্চাকে সময় দিতে পারছি। কেন আমি আমার সৎ পরিশ্রমে গড়ে তোলা ব্যবসাকে ছোট করে দেখব?
আমার ব্যবসা নিয়ে একমাত্র আমার মা-ই আমাকে মানসিকভাবে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ উইমেন্স চেম্বার অব র্কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য ছিলেন। আমাকে সেখানে নিয়ে সদস্য করে দেন। তাদের মাধ্যমে আমি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পেরেছি। লাইটক্যাসল পার্টনার্স এর সাথে আমার পরিচয় এবং তাদের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে যোগদান করাও হয় সেখান থেকেই। তাদের প্রোগ্রাম থেকে আমি ব্যবসা নিয়ে বেশ নতুন জ্ঞান অর্জন করি। সেখান থেকে আমি বেশ কিছু ক্রেতার সন্ধানও পেয়েছি।
২০১৭ সালে এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমার একটি রান্নার প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ হয়। সেখানে আমি বেকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রান্নার কাজ শিখি। এই কোর্স করার পর, আমি দিনাজপুরে ১৫ জন নারীকে রান্নার প্রশিক্ষণ দেই। অন্যকে প্রশিক্ষণ দেবার জন্য আগে সেই বিষয়ে নিজের গভীর জ্ঞান থাকা জরুরি। তাই আমি সুযোগ পেলেই রান্নার প্রশিক্ষণে যোগ দেই এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষক হিসেবে অন্যকে শেখাই।
আমার ব্যবসা স্থিতিশীল হওয়ার পর আমি বিভিন্ন রকমের পণ্য আনতে শুরু করি। গত দুই বছর ধরে আমি খেজুরের গুড় বিক্রি করছি। বেশ কিছুদিন ধরে আমি পাপর, পিঠা ইত্যাদি বিক্রি করি। যখনই আমি আকর্ষণীয় কিছু দেখি আমি সেগুলি নিয়ে আসি। আমার গ্রাহকরা যদি সেগুলো পছন্দ করে, তবে আমি পরবর্তীতে আবারো সেগুলো আনি। ২০১৯ এর শেষের দিকে, আমি শাহবাগে পার্টনারশিপে একটি মোবাইল ফুড কার্ট দেই। খোলার কিছুদিন পরেই, শাহবাগে আন্দোলন শুরু হওয়াতে ফুড কার্টটি বন্ধ রাখতে হয়। অবশেষে কার্টটি আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আমার ব্যবসার পার্টনারও আমাকে এক্ষেত্রে কোন সহযোগিতা করেন নি। আমি পুনরায় আমার অনলাইন ব্যবসায় মন দেই। মহামারি চলাকালীন বেশিরভাগ ব্যবসাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে আমার গল্পটা একটু ভিন্ন।
লকডাউন চলাকালীন, হোটেলগুলি বন্ধ ছিল। বেশিরভাগ বাড়িতে কাজের লোক ছিল না। সুতরাং, ঘরে তৈরি খাবারের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সবাই অনলাইনে খাবার ডেলিভারির ব্যপারটির সাথে পরিচিত হচ্ছিল। এই কারণে, আমার ২০২০ সালে খুব ভাল ব্যবসা হয়েছিল I তুলনা করলে এই বছর আমার ঘরে তৈরি খাবারের আইটেম বিক্রি কমে গিয়েছে। আমি আমার খাটি পণ্যগুলি, আম, লিচু এগুলি বিক্রি করে সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিচ্ছি।
আমার এই স্বল্প সময়ের ব্যবসার যাত্রায় সমস্যা ছিল বহুরূপী। তবে এখন আমি নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করি। সব বাধার বিপরীতে যেয়ে আমি ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছি। ৫০ টাকা দিয়ে শুরু করে, এখন আমি তিনটি কর্মচারী রেখে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসাটি চালাচ্ছি। আমি অবশ্যই আমার ব্যবসাটিকে প্রসারিত করে একটি খাবারের দোকান দেবার স্বপ্ন দেখি। আমার বাবার সহযোগিতা পেলে, এই স্বপ্ন পূরণ করা এতটা কঠিন হত না। আমা আশা করি, সব বাবা তাদের মেয়েদের সৎ চেষ্টাকে উৎসাহ দেবেন এবং তাদের স্বপ্ন পূরণে তাদের শক্তি হয়ে পাশে থাকবেন। ভাল সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে আমি একটি দোকান ভাড়া করে আমার ছেলেকে নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই।