বিএ পাশ করার পর প্রথমে আমি বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রির ব্যবসায় নেমে পড়ি। আরও কিছু আয়ের জন্য আমি পাশাপাশি মাছ চাষের কথা চিন্তা করি। যেই ভাবা, সেই কাজ। একরকম শখ করেই ছোট ভাইয়ের সাথে ১২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ নিয়ে শুরু করি সবুজ মৎস্য হ্যাচারি। পাবদা, শিং, মাগুর, টেংরা ইত্যাদি মাছের পোনা কিনে আমি মাছ চাষ শুরু করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে, আমার সব মাছ মারা যায়। সাথে আমি হারাই আমার সমস্ত পুঁজি।
আমি আমার মাছের মৃত্যুর পেছনের কারণ খুঁজতে নেমে পড়লাম। নিজে নিজেই গবেষণা চালিয়ে বুঝতে পারলাম ভাগ্যের দোষে নয়, আমার ভুলের কারণেই মাছগুলি মারা গেছে। পরিচিতজনদের দেওয়া ভুল পরামর্শের কারণে, মাছের পোনা কেনার সময় তাদের বয়স নির্বাচনে আমি বিশাল ভুল করেছিলাম। পাবদার পোনাগুলি ছিল বড়, অন্য মাছের পোনাগুলি ছিল ছোট। স্বাভাবিকভাবেই, বড় মাছগুলো ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। আমার ব্যবসার সব অর্থ ক্ষতি হয়েছিল, তবু আমি নিরাশ হইনি। আমি স্থির করলাম, যে ব্যবসা থেকে টাকা হারিয়েছি, সেই ব্যবসা থেকেই ক্ষতির টাকা তুলব।
আমি আমার মামার কাছ থেকে ধার করে এবং বেশ কিছু এনজিওর কাছ থেকে লোন নিয়ে আবার মাছ চাষ শুরু করলাম। এবার আমি ছিলাম আগের চেয়ে সচেতন, মাছ চাষ নিয়ে ধারণা ছিল আগের চেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি ছিল আত্মবিশ্বাস। আমার ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। এরপর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে, আমার দুইজন কর্মচারী আছে। একজন পুকুর দেখাশোনা করে, আরেকজন হ্যাচারি। আমি আমার সমস্ত ঋণও ফেরত দিয়েছি।
খুব প্রচলিত একটি কথা আছে- ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। সত্যিই তাই। আমাদের দেশের মানুষ সবসময় মাছ খেতে পছন্দ করেন। তাই মাছের চাহিদা সবসময়ই থাকে। আমি পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে মাছগুলি বিক্রি করি, তারা সারাদেশে আমার মাছ পৌঁছে দেয়। এছাড়া আমার মাছ ভারতেও রপ্তানি হয়।
সবুজ মৎস্য হ্যাচারির একটি ফেসবুক পেজ আছে। আমার মাছ বেশিরভাগই পাইকারি বিক্রেতা ও রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে বিক্রি হয়। তবে এই ফেসবুক পেজটি থেকে আমি বেশ উপকৃত হয়েছি। ফেসবুকের মাধ্যমে আমি তুলনামূলক কম দামে মাছের হরমোন কিনতে পারছি। পূর্বে আমি সরাসরি দোকান থেকে যে হরমোন ২৫০০ টাকায় কিনতাম, এখন আমি একই পণ্য অনলাইন থেকে ১৮৫০ টাকায় কিনতে পারছি। এতে আমার অনেক বড় একটি ব্যয়ের পরিমাণ কমেছে।
ওয়ার্ল্ড ফিশ আয়োজিত একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সময় আমি লাইটক্যাসল পার্টনার্স সম্পর্কে জানতে পারি। লাইটক্যাসল আমাদেরকে ব্যাংক থেকে লোন গ্রহণের পদ্ধতির মত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে শিখিয়েছে। নিঃসন্দেহে ট্রেনিং সেশনগুলি খুব উপকারী ছিল। সারা দেশ থেকে আসা আমার মতো অনেক উদ্যোক্তার সাথে দেখা করতে পেরে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার জন্য এটি ছিল চমকপ্রদ একটি অভিজ্ঞতা।
কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে আমার ব্যবসাটি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। ট্রেড বন্ধ থাকায় রপ্তানিকারকরা ভারতে মাছ রপ্তানি করতে পারেনি। এমনকি এই মুহুর্তে আমার কাছে ৬০-৭০ মণ অবিক্রিত মাছ রয়েছে। মহামারিতে সামগ্রিকভাবে মাছের চাহিদা কমেছে। ফলে মাছের দামও কমেছে। যেমন স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মণ পাবদা মাছের দাম ১৫,০০০ টাকা, যা করোনার কারণে সম্প্রতি ১০,০০০ টাকায় নেমেছে।
আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তবে এত দিনের ব্যবসার উত্থান-পতনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটি জিনিস শিখেছি। যত দুঃসময়ই আসুক, কখনোই হাল ছাড়া যাবেনা। ব্যবসাকে ভালবাসতে হবে, কাজকে ভালবাসতে হবে। আমার ব্যবসাটি ভবিষ্যতে আমি আরো বড় করতে চাই। সঠিকভাবে এর সম্প্রসারণ করতে আমার প্রায় ১৫ লক্ষ বিনিয়োগের প্রয়োজন। আমি ইতোমধ্যে মাছের রুমের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ১০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছি। মাছ চাষ আমার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে। এখন এটিই আমার বড় পরিচয়। আমি সাহসের সাথে বলতে পারি, আমি আমার ব্যবসায় এত বছর যাবত যে শ্রম, সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ করেছি তা আমি কখনো বৃথা যেতে দেব না।